ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সমুহ
ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষ এক আদমের সন্তান। পেশা, বর্ণ বা অঞ্চলের ভিত্তিতে মানুষের মাঝে কোনোরূপ বিভাজন হতে পারে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৈষয়িক উন্নয়ন সত্ত্বেও শ্রেণিবৈষম্য মানুষকে চরম নৈতিক অধঃপতনের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ইসলামী সমাজে একদিকে যেমন মালিক-শ্রমিকের শ্রেণীবিভাগ বা উদ্ভূত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবকাশ নেই; তেমনি পারস্পরিক স্বার্থোদ্ধারের বিভেদমুক্ত থেকে সৌহার্দ্যপূর্ণ ভ্রাতৃসুলভ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ, শ্রমিক ছাঁটাই ও গুজব রটিয়ে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ইস্যু তৈরি ইত্যাদি অনভিপ্রেত অবস্থার উদ্ভব হতে দেখা যায়। বস্তুত এসব বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে মালিকের প্রধান কর্তব্য হলো কর্মদক্ষ, সুদক্ষ শক্তি-সামর্থ্যবান, আমানতদার ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে কাজে নিয়োজিত করা এবং সময়, কার্যকাল ও ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করে শ্রমিককে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ করা। শ্রমিকের বেতন-ভাতা যতক্ষণ পর্যন্ত স্থির করা না হবে এবং সন্তুষ্টচিত্তে সে তা গ্রহণ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে জোর করে বা ভয়ভীতি দেখিয়ে কাজে নিযুক্ত করা ইসলাম সম্মত নয়।
শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি
ইসলাম মতে, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি প্রত্যেক শ্রমিকের প্রয়োজন ও কর্মানুসারে নির্ধারিত হবে। আর শ্রমিককে কমপক্ষে এমন মজুরি দিতে হবে, যাতে সে এর দ্বারা তার ন্যায়ানুগ ও দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। শ্রমে নিযুক্ত প্রতিটি শ্রমিকেরই ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। এ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা যাবে না। শ্রমিকের ন্যায্য প্রাপ্য মজুরি পরিশোধের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’- (ইবনে মাজাহ)।
কাজ সম্পাদন করামাত্রই শ্রমিককে তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক প্রদান করা মালিকের সর্বপ্রধান দায়িত্ব। এ ব্যাপারে ইসলামের প্রথম কাজ হলো, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি দিতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিযুক্ত করবে না’- (বুখারি, বায়হাকি)।
রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপন করবেন। তন্মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছে, যে ব্যক্তি কাউকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করে, তার দ্বারা পূর্ণ কাজ আদায় করা সত্ত্বেও তাকে পারিশ্রমিক প্রদান করে না’- (বুখারি, দ্বিতীয় খণ্ড)।
শ্রমিকের মর্যাদা
ইসলাম শ্রমিক ও মালিকের ওপর পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় শ্রমনীতি প্রণয়ন করেছে। কেননা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই যেকোনো সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। আর ইসলাম শ্রমিকের যে মর্যাদা প্রদান করেছে, পৃথিবীর যেকোনো ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। ধরিত্রীতে সর্বপ্রথম মহানবী (সা.)-ই ঘোষণা করেছেন- ‘শ্রম-মেহনত পড়ে থাকা জিনিস নয়’। তিনি বলেছেন, ‘সব নবী বকরি চরিয়েছেন।’ সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.), আপনিও কি? উত্তরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’ আমিও কয়েক ‘কিরাত’ (সামান্য অর্থ)-এর বিনিময়ে মক্কাবাসীর বকরি চরিয়েছি- (বুখারি)।
তিনি আরো বলেছেন, ‘অধীনদের সঙ্গে অসদাচরণকারী বেহেশতে যেতে পারবে না’- (তিরমিজি)।
পৃথিবীতে অন্য কোনো ধর্মে শ্রমিকদের এতটা মর্যাদা-সম্মান প্রদান করা হয়নি। সম্পদশালী, বিত্তবান, অঢেল বিত্ত-বৈভবে পূর্ণ ব্যক্তিকে সমাজের উচ্চস্থান দেওয়াকে ইসলাম সমর্থন করে না। বরং প্রত্যেক সৎকর্মশীল ও পরহেজগার ব্যক্তিই আপন নৈতিকতা, পরিশুদ্ধ কর্মকাণ্ডের জন্য সমাজ-সংসারে বেশি সম্মান, মর্যাদা ও শ্রদ্ধাভাজন হতে পারেন। ইসলাম শিক্ষা দেয়, শ্রমিক-মজুর আপনার-আমার মতো রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। তাদেরও অনুভূতি আছে, আছে মান-মর্যাদাসমেত স্বাভাবিক জীবনকাল নির্বাহ করার। তারাও নিজ পরিশ্রমে ইসলামী সমাজে মর্যাদা লাভ করতে পারে। ইসলামের এই মৌলিক সত্যটির দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহপাক বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই বেশি মর্যাদাবান, যে অধিক পরহেজগার’- (৪৯:১৩)। ইসলামের উক্ত দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আমরা ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাই, একজন সৎকর্মশীল ও পরহেজগার শ্রমজীবী মানুষ একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির থেকে বহুগুণ উঁচুস্তরের। পেশায় শ্রমিক-মজুর বলে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা নেই। কেননা ইসলাম তার মর্যাদা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সংরক্ষণ করেছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে মালিক শ্রমিক, উঁচু-নীচু, আমীর-গরিব, বাদশাহ্-ফকির সবাই সমান, যার মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পূর্ববর্তী সব নবী ও রাসুল এবং আল্লাহর প্রিয় হাবীব (সা.) একজন শ্রমজীবী মানুষ ছিলেন। অনেক দিন পর্যন্ত তিনি নিজের শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে লভ্যাংশের অংশীদার হয়ে হজরত খাদিজার (রা.) ব্যবসায় শ্রম দিয়েছেন। ইসলাম একজন শ্রমজীবী মানুষের জন্য অফুরন্ত সম্ভাবনা ও আশার কথা বলেছে। তাই আমরা ইসলামী সমাজব্যবস্থায় দেখি, একজন শ্রমিক বা মজুরও রাষ্ট্রীয় কর্ণধার হতে পারে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি মদিনার গভর্নর হয়েছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে আমরা দেখি রাসুল (সা.)-এর বংশধর হজরত জয়নুল-আবেদীন নিজের এক দাস শ্রমিককে স্বাধীন করে দিয়ে ঔরসজাত কন্যাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেননি। শ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তারা (অধীন ব্যক্তিরা) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং আল্লাহ যার ভাইকে তার অধীন করে দিয়েছেন, সে তার ভাইকে যেন তা-ই খাওয়ায়, যা সে নিজে খায়, তাকে তা পরিধান করতে দিবে, যা সে পরিধান করে। আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর ও সাধ্যাতীত, তা করার জন্য তাকে বাধ্য করবে না। আর সেই কাজ যদি তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয়, তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে’- (বুখারি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৮৯৪) ।
শ্রমিক-মজুরদের মর্যাদা দেওয়ার আরেকটি প্রামাণ্য ঘটনা আমরা দেখতে পাই হজরত উমর (রা.)-এর জীবনে। তিনি সুবিশাল সাম্রাজ্যের অধিশ্বর বা খলিফা হয়েও নিজের শ্রমিককে উটের পিঠে চড়িয়ে তার সম্মান, কদর ও মর্যাদা দিতে কোনোরূপ কার্পণ্য করেননি। এরূপ দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। কবির ভাষায়- ‘ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি/ মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী’- (কাজী নজরুল ইসলাম) ।
ইসলাম সামাজিক আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান দূর করেছে। এমনকি নামগত পার্থক্যটুকুও দূর করে দিয়েছে। শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষদের মর্যাদাহীন কোনো শব্দ ব্যবহার পর্যন্ত ইসলাম অনুমোদন করে না। এমনকি কোনো শ্রমিককে দাস বলা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আরবের প্রচলিত ভাষা ছিল মালিক ও মনিবকে ‘রাব্ব’ বা প্রতিপালক বলা। কিন্তু পবিত্র ধর্ম ইসলামে এ ধরনের কথাকেও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ এতে মালিকের মনে অহংকারবোধ ও শ্রমিকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার ধারণা জন্ম হতে পারে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ”তোমাদের মধ্যে মালিক বা মুনিবকে কেউ ‘রাব্ব’ বলতে পারবে না। কারণ তোমরা সবাই গোলাম বা প্রতিনিধি। একমাত্র আল্লাহই সবার রাব্ব বা প্রতিপালক।”
ইসলামে শ্রমের গুরুত্ব
জীবিকা অর্জনের অন্যতম উপায় শ্রম। এ কারণেই মানবদরদী নবী (সা.) শ্রম বিনিয়োগের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমজীবীর উপার্জনই উৎকৃষ্টতর, যদি সে হয় সৎ উপার্জনশীল’- (মুসনাদে আহমদ)।
আল কোরআনে ইসলামের অন্যতম প্রধান রোকন সালাত কায়েমের পাশাপাশি উৎপাদনমুখী কর্মে ব্যাপৃত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। তাই তো ঘোষণা এসেছে, ‘যখন তোমাদের সালাত শেষ হয়ে যাবে, তবে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো। আর আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে যাও’- (৬২:১০)।
যুগে যুগে প্রত্যেক নবীই নিজ নিজ শ্রমলব্ধ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল পথে শ্রম বিনিয়োগ বিন্দুমাত্রও লজ্জার ব্যাপার নয়। বরং এ হচ্ছে নবীগণের সুন্নাত। ‘মুসতাদরাকে হাকিম’ গ্রন্থে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, হজরত দাউদ (আ.) বর্ম তৈরি করতেন। হজরত আদম (আ.) কৃষি কাজ করতেন। হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। হজরত ইদরীস (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন এবং হজরত মূসা (আ.) রাখালের কাজ করতেন- (ফাতহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড পৃ. ৩০৬)। সাহাবায়ে কেরাম নিজেরা যেমন শ্রমদানে অভ্যস্ত ছিলেন, তেমনি অন্যদেরও শ্রমদানের প্রতি উৎসাহিত করতেন। নবী দুলালী ফাতেমা (রা.) পানি টানতে গিয়ে বুকেপিঠে দাগ পড়ে যেত, যাঁতা ঘুরাতে ঘুরাতে হাতে ফোসকা পড়ে যেত, তবুও তিনি শ্রম-বিমুখ হননি।
এমনকি মানবসেবার মূর্ত প্রতীক মহানবী (সা.) খন্দক যুদ্ধের প্রাক্কালে নিজ হাতে পরিখা (দূর্গ) খনন কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের মহান পেশাকে সম্মানিত করেছেন।
ভিক্ষাবৃত্তি ও ইসলাম
বর্তমানে আমাদের দেশে ভিক্ষাবৃত্তি একটি ব্যাধিতে রূপ নিয়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই অগণিত ভিক্ষুককে কর্ম ও শ্রমের প্রতি নিদারুণ অনীহা পেয়ে বসেছে। ফলে তারা ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি যাওয়া, ফুটপাত, ফুট-ওভার ব্রিজ, রাস্তায় চলমান গাড়ি কিংবা যানজটে আটকেপড়া গাড়ি থামলেই হুমড়ি খেয়ে পড়া তাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তিকে পছন্দ করে না। তাই তো মহানবী (সা.) ভিক্ষাবৃত্তির পরিবর্তে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহের প্রতি জনৈক ভিক্ষুককে শিক্ষা দিয়েছিলেন। একবার তিনি বলেছেন, ‘যে কোনো দিন ভিক্ষা করবে না বলে আমার সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হবে, তার জান্নাত লাভের দায়িত্ব আমি নিলাম’- (আবু দাউদ)। তাই দেশের এসব ভিক্ষুক গোষ্ঠীকে কর্মজীবী শ্রমের আওতায় আনতে সরকার ও সচেতন নাগরিকদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও গবেষক
mahbub.alam430@yahoo.com